বই-এই অতি সাধারণ শব্দটি নিজের সাথে যুগ যুগ ধরে বহন করে নিয়ে চলেছে প্রচুর ইতিহাস। সেই ইতিহাসের শরিক যেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বীরসিংহের ব্রাম্ভনসন্তান,ঠিক তেমনই ভ্রাতৃহন্তা মুঘল সম্রাটও তার সমান ভাবে শরিক। পৃথিবীর এমন কোন সভ্য জনজাতি নেই যারা এ বস্তুটির স্বাদাস্বদন করেনি। কেউ কেউ মানবতার এই অমোঘ সৃষ্টিকে মাথায় করে রেখেছে আবার কেউ স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে জ্বালিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি থরে থরে সাজানো এই ইতিহাসের সাক্ষীকে। শাসকের দুর্দমনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যখন গর্জে উঠেছে লেখকের কলম তখন এই বস্তুটিই দুমলাটে জড়িয়ে স্বযত্নে লালন করেছে সেই বিপ্লবকে। আবার যখন ধূর্ত শাসক প্রয়োজন মনে করেছে ,
নিজের প্রোপাগান্ডা জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তখন বিক্রি হয়ে যাওয়া কলমের লেখাও পরিবেশিত হয়েছে ঐ একই মাধ্যমে,এবং কিছুক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসে মুঠোফোন,বোকাবাক্স এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে বইসংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠলেও মৃত্যু হয়নি কখনোই। আজো প্রেমিকের অবুঝপনায় ডায়েরির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা বেদনাগুলোর ওপর ঝরে পড়ে অষ্টাদশীর চোখের ফোঁটা ফোঁটা জল। লাশকাটা ঘরের দুর্গন্ধ ছাপিয়ে হোমিসাইডে দপ্তরের অফিসারের অবচেতনে ঘুরপাক খেতে থাকে আততায়ীর অপরাধের প্যাঁচ পয়জার,যা ক্রমে স্থান পায় খাতার পাতায়। সেই ডায়েরিরা,সেই খাতারা সময় মত পাঠক মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ ঘটায় নানা রঙের,নানা ধরণের মলাটে মুড়ে।
'গ্রন্থকীট' মূলতঃ একটি গোয়েন্দা উপন্যাস। নামকরণ দেখে,গ্রন্থ অর্থাৎ বইকে ঘিরেই যে উপন্যাসটি গঠন করা হয়েছে তা বলাই যায়। তবে বইকে কেন্দ্র করে একটি মানুষের জীবনে কত কিছু ঘটে যেতে পারে তার এক স্বচ্ছ বর্ণনা উপন্যাসটির মাধ্যমে পাঠকদের সামনে তুলে ধরা যাবে বলে মনে করাই যায়। আমাদের চেনা পরিচিত অঞ্চলের অলি গলি ধরেই এগিয়েছে এই উপন্যাসের প্রবাহ।
এই উপন্যাসের গোয়েন্দা চরিত্রে আছে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কবীর আলি এবং তার বন্ধু সমীর ব্যানার্জী। 'কবীরহস্য' নভেলা সংকলনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে গত বছর বইমেলায় তাদের প্রথম আত্মপ্রকাশ। পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে কিনা সেটা সময় বলবে তবে ভালোবাসার ভাগীদার যে হয়েছে তা বলাই চলে। 'অজগর অন্তর্ধান রহস্য' এবং 'ফ্যাবিউলিনাসের অভিশাপ' পেরিয়ে কবীর এবার 'গ্রন্থকীটের' সন্ধানে।
হঠাৎই পরপর খুন হন বইপাড়ার এক প্রখ্যাতনামা প্রকাশক এবং একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। না চাইতেও এই হত্যারহস্যের সমাধানে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে কবীর। ইতিমধ্যে লালবাজারের ঘাম ছুটে গেছে এই আততায়ীকে ধরতে,ধরা তো দূরের কথা কোন মোটিভ খুঁজে বের করতে পারেননি হোমিসাইডের দুঁদে গোয়েন্দারা। তদন্তে নেমে কবীর জানতে পারে খুনগুলোর ধরণ অত্যন্ত অদ্ভুত এবং খানিকটা যেন এক সুতোয় বাঁধা। উপরন্তু খুন করতে যে বস্তুগুলি ব্যবহার হয়েছে তা এই শহরে বসে আততায়ী কি করে যোগাড় করল তা ভেবে কপালের ভাঁজ গভীর হয়ে ওঠে কবীরের।
কি সেই জিনিস যা দেখে দুশ্চিন্তাময় হয়ে পড়ল কবীরের মতন মানসিক ভাবে দৃঢ় তদন্তকারী! খুনের ধরণে মিল মানে কি মহানগরে আবার হানা দিল কোন সিরিয়াল কিলার? খুনগুলোর সাথে বইয়ের সম্পর্কই বা কোথায়? একটা বইয়ের জন্য কি মানুষ মানুষকে সত্যিই খুন করতে পারে? আমরা যে বইপাড়াকে চিনি সত্যিই কি ঠিক চিনি না সেই চেনার অগোচরে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার জগৎ যা আমরা ঘোর দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা! দুটো খুনেই কি এই কাহিনীর সমাপতন হবে না কোলকাতার মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে আরো কোন বড় বিপদ?
সোদপুরের এঁদো গলি পেরিয়ে,কলেজস্ট্রিটের গমগমানিকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে,রাজারহাটের চাকচিক্যকে ম্লান করে দিয়ে,মেটিয়াবুরুজের রক্তাক্ত গলি দিয়ে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে ….
গ্রন্থকীট আসছে।